ঘড়ির মোড়ের ঠিক পশ্চিম দিকে রাস্তার ধারে ফুটপাথের অজস্র অস্থায়ী দোকানের রকমারি পসরার আড়ালে এক সুদীর্ঘ ইতিহাসের নিশ্চুপ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে চুঁচুড়া গির্জা বা চিনসুরা চার্চ।
১৮২৫ সালে স্থাপিত এই চার্চটির আগে চুঁচুড়ায় আরও দুটি চার্চ ছিল, এক আর্মানি টোলার আর্মেনিয়ান চার্চ অফ সেন্ট জন, দি ব্যাপটিস্ট (স্থাপিত ১৬৯৫) এবং ঘন্টাঘাটের ওলন্দাজ চার্চ। যদিও এর বেশ কিছু কাল আগে, হুগলীতে ইংরেজরা যখনতাঁদের প্রথম কুঠি নির্মাণ করেন তখন সেখানে ১৬৭৯ সালে একটি ছোট চ্যাপেলের অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়। সেই চ্যাপেলের চ্যাপেলিন ছিলেন রেভারেন্ড জন ইভান্স। ১৬৮২ সালে উইলিয়াম হেজেস হুগলীর কুঠি পরিদর্শনে এলে রেভারেন্ড ইভান্সের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা হয় এবং তাঁরা একত্রে ঢাকা এবং বালাসোরের কুঠি পরিদর্শনে যান। কিন্তু এর কিছুকাল পরেই ১৬৮৫ সালে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের বাহিনীর সঙ্গে হুগলীর ব্রিটিশ বাহিনীর যুদ্ধ হয় এবং সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইংরেজ কুঠির প্রধান জোব চার্ণক সহ চুঁচুড়াস্থিত বাকি ইংরেজরা হুগলীর কুঠি পরিত্যাগ করে সুতানুটি তে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
ব্রিটিশদের পরিত্যক্ত হুগলীতে এরপর ওলন্দাজরা তাঁদের কুঠি নির্মাণ করে বাণিজ্য শুরু করেন এবং দীর্ঘ একশ চল্লিশ বছর ভারত বর্ষে বাণিজ্য করার পর তাঁরা অবশেষে রণে ভঙ্গ দেন। ভারতে যেমন তখন ব্রিটিশ রমরমার প্রভাব তুঙ্গে, ঠিক সেরকমই ওদিকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ওলন্দাজদের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এহেন পরিস্থিতিতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় আরও গভীরে মনোনিবেশের লক্ষ্যে ওলন্দাজরা ভারত থেকে তাঁদের যাবতীয় বাণিজ্য গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১৮২৪ সালে ইংরেজ এবং ওলন্দাজ সরকারের মধ্যে ইঙ্গ-ডাচ চুক্তির মাধ্যেমে উপনিবেশ হস্তান্তরিত হয়। ইংরেজরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মালয় দ্বীপপুঞ্জে নিজেদের ব্যবসার পাট চুকিয়ে দেন আর বদলে ডাচরা ভারত থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে নেন। এই চুক্তির ফলে দীর্ঘ প্রায় একশ চল্লিশ বছর পর ইংরেজরা পুনরায় হুগলি শহরের অধিকার লাভ করেন এবং ১৮২৫ খৃষ্টাব্দে হুগলীর চুঁচুড়া শহর আবার ব্রিটিশদের দখলে আসে। সেই বছর চুঁচুড়ায় স্থাপিত হয় চিনসুরা চার্চ।
প্রাথমিক ভাবে চুঁচুড়া চার্চ ছিল ফ্রী চার্চ। পরে এটি ইউনাইটেড চার্চ অফ নর্থ ইন্ডিয়া এর অন্তর্ভুক্ত হয় ও বর্তমানে CNI এর আওতাধীন। এই চার্চের প্রথম পাদ্রী রেভারেন্ড মাইকেল জন ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত এর দায়িত্ব সামলান। ১৮৭১ সালে রেভারেন্ড পি কে চ্যাটার্জি এই গির্জার প্রথম বাঙালী পাদ্রী হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যিনি পরে চুঁচুড়া ডাফ স্কুলে শিক্ষকতাও করতেন। তবে ১৮২৫ সালে এই চার্চ ঠিক কে বা কারা পত্তন করেন কিম্বা এই ফ্রী চার্চের সঙ্গে অ্যালেকজান্ডার ডাফ সাহেবের স্কটিশ ফ্রি মিশনের কোনও যোগাযোগ ছিল কিনা ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি কেউই। এখানকার বর্তমান পাদ্রী রেভারেন্ড গৌরাঙ্গ হালদার দেড় বছর হল এখানে এসেছেন এবং তিনিও এই ধোঁয়াটে ইতিহাসের খোঁজ দিতে পারেননি।
চুঁচুড়া চার্চের পাদ্রীদের তালিকা
চুঁচুড়া চার্চের বর্তমান পাদ্রী রেভারেন্ড গৌরাঙ্গ হালদার
তবে হারানো ইতিহাসের হদিশ দিতে না পারলেও তিনি আমাদের এই প্রার্থনা মন্দিরের বর্তমান সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দিলেন। প্রার্থনা মন্দিরের অভ্যন্তর ভাগটির কিয়দ অংশ ২০০২ সালে সংস্কার করা হয়। সংস্কারের ফলে অভ্যন্তরভাগে লেগেছে কিঞ্চিৎ আধুনিকতার ছাপ, দেওয়ালে বসানো হয়েছে আধুনিক ডিজাইনের টাইলস। তবে গির্জার ভিতরে যাই হোক, বহির্ভাগে এখনও সেই প্রাচীন স্থাপত্য শৈলীর নিদর্শন বিদ্যমান। বিশেষত সামনের দিকের অক্ষত টালির শেডটি এমন এক বিশেষ শৈলীর অঙ্গ যা প্রাচীন হুগলী – চুঁচুড়ার কলোনিয়াল যুগের স্থাপত্য ভিন্ন আজকাল অন্য কোথাও খুব একটা চোখে পড়েনা। গির্জার এক পাশে রয়েছে পার্সোনেজ বা ধর্ম যাজকের বাসস্থান যা ১৯৫৮ সালে রেভারেন্ড সুধাংশু ঘোষ নির্মাণ করান। তার সামনেই রয়েছে ছোট্ট একটুখানি সবুজ ঘাসের লন যেখানে নিয়মিত যত্নের ছাপ স্পষ্ট।
দশ হাত দূরে এই সাবেকী গির্জা চত্বরের ঠিক বাইরেই যখন এই পুরনো শহরটা আধুনিকতার চাপে প্রতি মুহূর্তে একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে ঠিক তারই মদ্যিখানে একটি মাত্র পাঁচিলের ব্যবধানে একশ নব্বই বছরের না বলা ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে হুগলীর চিনসুরা চার্চ।
ছবি- © প্রোজ্জ্বল দাস