সুবর্ণবণিকদের পুজো- মল্লিকবাড়ির ৩৭৫ বছরের দুর্গাপুজো (Durgapuja of Suvarna Banik Family- 375 years old Puja of Mallick Bari)

হুগলীর প্রাচীন সুবর্ণ বণিক পরিবারের দুর্গা পুজোর প্রসঙ্গে আজ বলব ৩৭৫ বছরের পুরনো একটি পারিবারিক পুজোর গল্প- প্রাচীন হুগলী শহরের ঘুটিয়াবাজারের মল্লিকবাটী দেবমন্দির বা মল্লিকবাড়ির পুজো।

IMG_8382-1
মল্লিকবাড়ি আটচালা

হুগলীর ঘুটিয়াবাজার অঞ্চলটির গল্প অতি প্রাচীন। আজ যেখানে হুগলী জিলা সংশোধনাগার, সেই জায়গাটিতেই মুঘল সম্রাট শাহজাহানের ফরমান পেয়ে ১৬৫১ সালে ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকরা বানিয়েছিল মাটির কাঁচা ইট আর পাতার ছাউনি দেওয়া কয়েকটি কুঠিবাড়ি। ঠিক যেখানে কিছুদিন আগে ছিল পর্তুগীজদের কুঠি, তার লাগোয়া জায়গাটিতে। এটিই বাঙলার মাটিতে তৈরি হওয়া প্রথম ব্রিটিশ কুঠি। এই কুঠিতেই প্রথম কুঠিয়াল ছিলেন ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম গভর্নর স্যার উইলিয়াম হেজেস, যাঁর দিনলিপির পাতা গুলি না থাকলে আজকের কলকাতার ইতিহাস লেখা হয়ত অসম্পূর্ণ থেকে যেত। এই কুঠিতেই হেজেসের পরে অল্প কিছুকালের জন্য দায়িত্বে ছিলেন জব চার্ণক। হুগলীর এই কুঠিকে কেন্দ্র করে পাশেই গড়ে উঠেছিল একটি প্রাচীন বাজার, যা কুঠিয়াল বাজার নামে পরিচিত ছিল। কালক্রমে কুঠিয়াল বাজারের নাম লোকমুখে পরিবর্তিত হতে হতে হয়ে গেল ঘুটিয়াবাজার বা আজকের ঘুঁটে বাজার! এই ঘুটিয়াবাজারে মল্লিক পরিবারের শতবর্ষ প্রাচীন ভদ্রাসন। এখানেই তাঁদের ঠাকুরবাড়ি আর তাঁদের দুর্গাপুজোর সূত্রপাত। সে কথায় আসছি, কিন্তু তার আগে আরেকটু পিছিয়ে গিয়ে মল্লিক বাড়ির ইতিহাসে একটু উঁকি দিয়ে দেখে নেওয়া যাক।

মল্লিকবাড়ির প্রাচীন অংশের কিছু অবশিষ্ট অংশ বিশেষ।

বিক্রমপুর থেকে সপ্তগ্রাম- সুবর্ণবণিকদের এক দীর্ঘ মাইগ্রেশান   

বাঙলায় তখন সেন রাজাদের রাজত্ব। সময়টা বারোশ’ শতকের শেষভাগ। গৌড়ের সিংহাসনে তখন বল্লাল সেন। যে সনক আঢ্য ও ১৬টি বণিক পরিবারের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যা থেকে বাঙলার বিক্রমপুরে চলে আসার গল্প আগের দিন বলেছিলাম, আজ বলবো তাদেরই এক উত্তরপুরুষ বল্লভ আঢ্যর কথা। বল্লভ আঢ্য ছিলেন গোষ্ঠাধিপতি, শ্রেষ্ঠী, সুবর্ণবণিক। বল্লাল সেন নাকি তাঁর কাছ থেকে নিয়মিত প্রচুর পরিমান অর্থ ধার নিতেন এবং নানা ছল করে সে টাকা আর শোধ করতেন না। একবার কী একটা কারনে বল্লাল লক্ষাধিক স্বর্ণমুদ্রা ধার চাওয়াতে বল্লভ আঢ্যর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল এবং তিনি বল্লালকে আগের ঋণ শোধ না করা পর্যন্ত আর কোনো নতুন ঋণ দেবেন না জানিয়ে দিলেন। উগ্রচণ্ডা স্বৈরতান্ত্রিক বল্লালের মেজাজ গেল গরম হয়ে। তিনি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে বসলেন –

“যদি দাম্ভিকান সুবর্ণান বণিজঃ শূদ্রত্বে না পাতরিষ্যামি
বল্লভচন্দ্র সৌদাগিরস্য দুরাত্মনো দন্ডাং না বিধাস্যামি
তদা গো ব্রাম্ভণ ঘাতেন যানি পাতকানি ভবিতব্যানি
তা নি মে ভবিষ্যন্তীতি”

    ~বল্লালচরিত 

অর্থাৎ, আমি যদি দাম্ভিক সুবর্ণদিগকে শূদ্রত্বে পতিত না করি, বল্লভচন্দ্রের মত দুরাত্মা সদাগরদের দণ্ড না দিই, তাহলে গো ব্রাহ্মণ হত্যার যে পাপ আমারও সেই পাপ হবে। অতএব রাজার ক্রোধে সুবর্ণ বণিকরা হলো জাতিচ্যুত। জল-অচল ব্রাত্য হয়ে বিপর্যস্ত বণিকরা বিক্রমপুর ত্যাগ করে ক্রমে বাঙলার বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। এদের মধ্যে কেউ কেউ এসে উপস্থিত হলেন রাজা বিক্রম কেশরীর রাজ্য উজানী নগরে (বর্তমান বর্ধমান জেলাস্থিত কাটোয়ার মঙ্গলকোট )। কিছুদিন শান্তিতে বাণিজ্যও করলেন। এখানকার শ্রেষ্ঠীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কৃষ্ণদাস চন্দ্র। এনার কথায় আমরা পরে আসছি।

কমবেশী একই সময়ে উজানীর আরও দক্ষিনে খড়গেশ্বরী বা খড়ি নদীর পাশে কর্জনা নগরে আর এক বণিকসমাজ গড়ে উঠেছিল। দেখতে দেখতে খড়ি নদী দিয়ে বয়ে গেল অনেক জল। গৌড়ের নবাব হলেন আলাউদ্দীন হুসেন শাহ (শাসনকাল ১৪৯৩-১৫১৯খ্রীঃ)। তাঁর কোষাধ্যক্ষ ছিলেন আজার খাঁ , বা অজ্জ্বরচন্দ্র, মতান্তরে অমরচন্দ্র। পরবর্তীকালে তিনি মল্লিক উপাধি লাভ করেন। তিনি আবার কর্জনার গোষ্ঠাধিপতিও বটে। ইনি এবং এনার উত্তর-পুরুষরা বংশলতিকার লতায় পাতায় ঘুঁটিয়াবাজারের মল্লিকবাড়ির পূর্বপুরষ। এই সময় আজার খাঁ মল্লিকের আহ্বানে বাঙলার সুবর্ণবণিক সমাজ একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করে।

কিন্তু এই সময়েই এমন একটি ঘটনা ঘটে গেল যার ফলে সুবর্ণবণিকদের ভাগ্যে আবারও ঘনিয়ে এলো বিপর্যয়ের কালো মেঘ।  আমরা আছি ১৫০০ শতকের শেষভাগে। তখনকার দিনে ব্রাহ্মণরা গণনা করে নানা রকম ভবিষ্যৎবাণী করতেন। গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহের কানে এরকমই একটি ভবিষ্যদবাণীর কথা উঠলো যা থেকে জানা গেল যে নবদ্বীপের ব্রাহ্মণ নাকি পুনরায় দেশের রাজা হবে। এই উটকো ভবিষ্যৎবাণীর ফলেই হোক বা অন্য কোনো রাজনৈতিক কারনেই হোক, শাসকদের অত্যাচার ও প্রজা-পীড়নের দমকা হাওয়া এসে লাগলো বণিকসমাজের পালে। কুলজী গ্রন্থে লেখা আছে,

“…চৌদ্দশত ছত্রিশ শকে ভাঙিল কর্জনা
রাজপীড়ায় পীড়িত হইল সর্বজনা।।”

অচীরেই কর্জনার বণিক সমাজ ছত্রভঙ্গ হল। দরকার হয়ে পড়ল নতুন একটি নিরাপদ ঠিকানার। সপ্তগ্রাম বন্দরের রমরমা তখন তুঙ্গে। বর্ধমানের পাট চুকিয়ে  দিয়ে সুবর্ণবণিকদের সোনার তরী গুলি একে একে ভিড়তে লাগলো সপ্তগ্রামের বন্দরে। আর এখানে আসার কিছু কালের মধ্যেই সুবর্ণবণিকদের রমরমা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেল। কবি কঙ্কণ তাঁর চন্ডীতে সপ্তগ্রামের বণিকদের সম্পর্কে বলেছেন,

“সপ্তগ্রামের বণিক কোথাও নাহি যায়,
ঘরে বসে সুখ মোক্ষ নানা ধন পায়।”

ওদিকে ঠিক এই সময়তেই সপ্তগ্রামের সরস্বতী নদীর শান্ত নদীতীরে আছড়ে পড়তে লাগলো আরেকটি ঢেউ, চৈতন্যদেবের ভক্তি আন্দোলনের প্রেমের ঢেউ। মহাপ্রভুর নির্দেশে তাঁর প্রধান পারিষদ প্রভু নিত্যানন্দ সপ্তগ্রামে এসে বল্লালী দণ্ডে ‘পতিত হিন্দু’ সুবর্ণবণিকদের একে একে বৈষ্ণব ধারায় দীক্ষা দিয়ে উদ্ধার করতে লাগলেন। প্রথমে তিনি সপ্তগ্রামের বণিক শ্রীকর দত্তর পুত্র দিবাকর দত্তকে রাধা মন্ত্রে দীক্ষা দান করলেন ও তাঁর নাম রাখলেন উদ্ধারণ।

“…বণিককুল উদ্ধার করিলি বটে সে কারণ।
আজি হইতে তোর নাম রহুঁ উদ্ধারণ।।”

~বাসুদেব ঘোষের চরিতামৃত

সেই থেকে দিবাকর দত্ত পরিচিত হলেন উদ্ধারণ দত্ত নামে। তিনি ছিলেন প্রভু নিত্যানন্দের অন্যতম প্রধান ভক্ত ও সেবক। তাঁরই সূত্র ধরে সপ্তগ্রামের সুবর্ণ বণিক গোষ্ঠীর সমস্ত পরিবার গুলি একে একে বৈষ্ণব প্রেমভক্তির জোয়ারে ভেসে গেল। তিনিই হুগলীর মল্লিক পরিবারেরও কুলগুরু।

uddharan-dutta-pic-bw
উদ্ধারণ দত্ত ( ছবি: গুগল থেকে সংগৃহীত)

ইতিমধ্যে পর্তুগীজরা পেল সপ্তগ্রামে ব্যবসার অনুমতি। প্রতিযোগীতা বাড়লো। অন্যদিকে, নৃপতি বল্লাল আরোপিত জল অচল সুবর্ণবণিক পেল কৃষ্ণপ্রেমের, নামজপের অধিকার। কালের নিয়মে সরস্বতী নদীও একদিন তার নাব্যতা হারালো। দক্ষিণ বঙ্গের বাণিজ্য লক্ষ্মী ক্রমে সপ্তগ্রাম ছেড়ে গঙ্গার ভাঁটিতে দক্ষিণে ভেসে চললো। সেই ভাঁটির টানে সুবর্ণবণিকদের  সওদাগরি নৌকা গুলিও আবার একে একে পাল তুলে দিল। এবার গন্তব্য হুগলী।

ফিরে আসি আজার খাঁয়ের কথায়। আজার খাঁয়ের ভাগ্নে পতিরাজ দে ছিলেন কর্জনার গোষ্ঠাধিপতি। তার পুত্র পরমানন্দের বংশে লক্ষ্মীনারায়ণ দে’র জন্ম। তিনি ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ের সুলতানের কাছ থেকে মল্লিক উপাধি লাভ করেন। তার কিছু কাল পরেই সপ্তগ্রামী দেব (মতান্তরে দে) পরিবার হুগলীতে এসে বর্তমান ঘুঁটিয়াবাজার অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। এই সময় সপ্তগ্রামী সুবর্ণবণিকদের চাল, সোরা, রেশম ও কার্পাসের ব্যবসা ছিল বলে জানা যায়। এছাড়াও ছিল আফিমের ব্যবসা। পারিবারিক বংশলতিকা থেকে সংগৃহীত তথ্য অনুসারে হরিলাল দেব (মল্লিক) আনুমানিক ১৫৮০-৯০ সালে এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। মল্লিকদের আরাধ্য দেবতা রাধাকৃষ্ণ তখন থেকেই মল্লিকবাড়ির পারিবারিক দেবমন্দির প্রাঙ্গনে পূজিত হয়ে আসছেন। সপ্তগ্রামের গোঁসাই উদ্ধারণ দত্তের কাছে দীক্ষাপ্রাপ্ত অনেকেরই উত্তরপুরুষরা এখনও এই মল্লিকবাড়ির দেবমন্দিরের সেবায়িত। শোনা যায় প্রভু নিত্যানন্দ ও শ্রীমৎ গোস্বামী (উদ্ধারন দত্ত) স্বয়ং এই দেবমন্দির প্রাঙ্গনে এসে গৌরলীলার প্রেমরাগে সকলকে মাতিয়ে দিয়ে গেছিলেন।

১০ই কার্ত্তিক মল্লিকবাড়ির কূলদেবতা কৃষ্ণরায় জিউয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস। বছরের ওই দিনেটিতে পাত পেড়ে লোক খাওয়ানোর চল এখনো আছে।

মল্লিকবাড়ির দুর্গাপুজো 

হুগলীর মল্লিক পরিবারের দূর্গাপুজোর শুরু আনুমানিক ১৬৪২ সালে। মল্লিকবাড়ির পুজো হয় বৈষ্ণব মতে। প্রথমে পুজো হত ঘটে। ১৮৫৫ সালে কলকাতার দরবারী দত্ত-রাই পরিবার শিব-দুর্গা রূপে পুজো চালু করার পর মল্লিকবাড়িতেও মা আসেন সপরিবারে, সাল ১৮৯০। একচালা মাটির প্রতিমা, শিবের কোলে দুর্গা। সাথে লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতী। আর আছে দুই সখী জয়া ও বিজয়া।

দেবী এখানে অভয়ামূর্তি, শান্তির প্রতীক। এই বাড়িতে কোনোদিন মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পুজো হত না। যদিও চালচিত্রের মধ্যভাগে মা দূর্গার মহিষাসুরমর্দিনী রূপটি জলরঙ দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়। চালচিত্রটি বিসর্জন দেওয়া হয়না।

DSC_0291-6-1
চালচিত্র

এবার একটু চোখ বুলিয়ে দেখা যাক মন্দির চত্বরটিতে। মন্দিরে ৬টি প্রকোষ্ঠ আছে। পূর্ব দিকের দ্বিতীয় ঘরটি বুড়োশিব জীউ-এর (শিবলিঙ্গ) আর উত্তরদিকের মধ্যিখানে ঘরে শ্রী শ্রী কৃষ্ণরায় (রাধা-কৃষ্ণর মূর্তি)  জীউ-এর । পুজোর সময় রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি সমেত সিংহাসনটি পাশের পশ্চিমদিকের ‘ঘটের ঘরে’ সরিয়ে দেওয়া হয়। পশ্চিম প্রান্তের ঘরটি বোধন বা ঘট পুজোর জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এবং এই দুটি ঘরের পূর্বদিকের একটি ঘর “মল্লিকবাটি স্কুলঘর” নামে পারিবারিক নথিপত্রে উল্লেখ আছে।

এই ঘর তিনটির সংলগ্ন ঠাকুর দালানে মল্লিকবাটি পাঠশালার ক্লাস হত, সময়কাল আনুমানিক ১৮৩০ খ্রী:। পরবর্তীকালে ঘুঁটিয়াবাজার শিবতলা সংলগ্ন স্থানে স্কুলটি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। রথযাত্রা অপেক্ষাও দোলযাত্রা হয় বেশী ধূম করে। জন্মাষ্টমীর পরের দিন নন্দোৎসবে আনুষ্ঠানিক ভাবে খুঁটিপুজো করে  শুরু হয় দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি।

বৈষ্ণব মতে পুজো হওয়ার ফলে মল্লিকবাড়ির পুজোয় চন্ডীপাঠ বলিদান ইত্যাদির প্রচলন নেই। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এইসব নিয়মকানুনে এসেছে শৈথিল্য। তবুও পুজোর চারদিন প্রতিটি মল্লিক পরিবার, এবং সেবায়িতদের বাড়ি থেকে পাঠানো নৈবেদ্য, ফলমূল , চাঁদমালা , দশমীর দধিকর্মা সাজিয়ে রাখার পর তিলধারণের জায়গা থাকেনা মল্লিকবাড়ির আটচালায়। ধুনো পোড়ানোর রীতি আছে। পরিবারের সধবা স্ত্রীলোকরাই শুধুমাত্র এই ধুনো পোড়ানোর অধিকার পেয়ে থাকেন। মহালয়ার দিন থেকে দশমীর দিন পর্যন্ত সমস্ত সেবায়েতদের বাড়িতে নিরামিষ খাওয়া হয়।

DSC01398-2-1
ধুনো পোড়ানো

মহালয়ার দিন ঘট বসানো হয়, সেই ঘটে পুজো হয় দশমীর দিন পর্যন্ত। দশমীর দিন মাকে সিঁদুর মিষ্টি দিয়ে বরণ করে বিদায় দেন বাড়ির স্ত্রীলোকেরা। ঠাকুরকে ঘর থেকে সামনের আটচালায় নামিয়ে বরণ করার সাথে সাথেই পরিবারে সমস্ত সদস্যরা ওই মৃন্ময়ী মূর্তিকে ঘিরে বসে পড়েন। ঢিমে লয়ে বাজতে থাকে বিজয়ার ঢাক। আট থেকে আশি পরিবারের সকলে গলা মেলায় শতাব্দী প্রাচীন একটি বিশেষ গানের সুরে। গানটি লিখে গেছেন এই পরিবারেরই স্বর্গীয় সুখদেব মল্লিক মহাশয়ের সহধর্ম্মিণী সুধাময়ী দাসী…

” … ওমা, বারেক হেরি ও চাঁদ বয়ান
হৃদয় ব্যাকুল কাঁদে পরান
ওমা, বরষ বরষ এস হেথায়
মা, একবার হেরি তোমায় “

শেষের এই চার লাইন ঘুরে ঘুরে আসতে থাকে বার বার, সেই সঙ্গে ঢাকের লয়ও ক্রমশ বাড়তে থাকে। গোটা নাটমন্দির প্রাঙ্গন বিষাদের করুণ সুরে ও ছন্দে কেঁপে কেঁপে ওঠে। পারিবারিক বিজয়ার পর্ব শেষে বাড়ির পুরুষরা কাঠামো সমেত মাকে কাঁধে তুলে নেয়। সকলে মিলে পদযাত্রা করে যাওয়া হয় পার্শ্ববর্তী গঙ্গার ঘাটে (মল্লিকঘাটে)। সেখানেই ঠাকুর বিসর্জন হয়, যেমন হয়ে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। এতো বছরের এতো মানুষের ইতিহাস, এতো আর্তি যেন ঘুরে ঘুরে ফিরে আসতে থাকে মল্লিক বাড়ির আটচালায়। “আসছে বছর আবার হবে”…

 

ছবি – সুচিন্ত্য মল্লিক

ঋণ –
ড: শংকর সেবক মল্লিক
শ্যামল মল্লিক
বন্দর সপ্তগ্রাম ও তার বণিকসমাজ; সুবর্ণবণিক কথা – অক্ষয়কুমার আঢ্য