ব্যান্ডেল ব্যাসিলিকা বা ব্যান্ডেল চার্চ বাংলায় নির্মিত প্রথম খ্রীষ্টান উপাসনা গৃহ। এটির নির্মাণকাল ১৫৯৯ খ্রীষ্টাব্দ। এটি একটি পর্তুগিজ চার্চ। ব্যান্ডেল চার্চের ইতিহাস সম্পর্কে জানার আগে সংক্ষেপে পর্তুগিজদের বাংলায় আসার ইতিহাসটি পড়ে নিতে পারেন।
পর্তুগিজরা প্রথম বাংলায় আসে ১৫১৮ খ্রীষ্টাব্দে। এর প্রায় ১৯ বছর পর ১৫৩৭ খ্রীষ্টাব্দে বাঙলার তৎকালীন নবাব মাহমুদ শাহের ফর্মানের বলে তাদের বাঙলায় ব্যাবসা-বাণিজ্যের স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরিত হয়। তবে ১৫৭৬ সালে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা অধিকার করার পরেই পর্তুগিজরা বাঙলায় ঘাঁটি গেড়ে বসতে সক্ষম হয়ে। বিভিন্ন কারণে পর্তুগিজদের ওপর খুশি হয়ে সম্রাট আকবর তাদের নানাবিধ ক্ষমতা ও স্বাধীনতা প্রদান করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বাঙলায় গির্জা নির্মাণ করে খ্রীস্টধর্ম প্রচার এবং ‘ইচ্ছুক’ ব্যক্তিদেরকে খ্রীস্টধর্মে দীক্ষা দেওয়া। খুব সম্ভবত ১৫৮০ সালে সরস্বতী নদীর ক্রমহ্রাসমান নাব্যতার কারণে পর্তুগিজরা সপ্তগ্রাম ছেড়ে ভাগীরথীর তীরে হুগলীতে বসতি স্থাপন করে। শীঘ্রই হুগলী হয়ে ওঠে বাঙলায় পর্তুগিজদের দখলে থাকা বন্দর শহর গুলোর মধ্যে সব থেকে সমৃদ্ধ এবং জনবহুল শহর। ১৫৮৮ সালে হুগলীতে আসা ব্রিটিশ পর্যটক ও বণিক র্যালফ ফিচ হুগলীকে পর্তুগিজদের প্রধান ঘাঁটি হিসাবে বর্ণনা করেন।
হুগলী শহরের উন্নতির সঙ্গেই বাড়তে থাকে ধর্মান্তরিত ভারতীয় খ্রিষ্টানের সংখ্যা। বাণিজ্যের পাশাপাশি পর্তুগিজদের এদেশে আসবার আরেকটি প্রধান লক্ষ্য ছিল খ্রীষ্টধর্মের প্রসার। ১৪৯৮ সালে কালিকটে পৌঁছানোর পর এক বণিকের প্রশ্নের জবাবে ভাস্কো-দা-গামার জাহাজের এক নাবিক উত্তর দিয়েছিলেন, “আমরা খ্রীষ্টান ও মশলার সন্ধানে এসেছি”। তবে ধর্মপ্রচারের পাশাপাশি পর্তুগিজদের আরেকটি অন্ধকার দিক ছিল দাস ব্যবসা। ১৬২১ থেকে ১৬২৪ সালের মধ্যে পর্তুগিজরা সুন্দরবন তথা বাংলার নদী সংলগ্ন অসংখ্য গ্রাম থেকে হিন্দু-মুসলিম মিলিয়ে মোট প্রায় ৪২,০০০ মানুষকে ক্রীতদাস বানিয়ে চট্টগ্রামে নিয়ে যায়, যাদের মধ্যে প্রায় ২৮,০০০ মানুষকে ধর্মান্তরিত করা হয়। ১৬৬৬ সালের এক নথি থেকে জানা যায় তখন শুধুমাত্র হুগলীতে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ছিল আট থেকে নয় হাজার।
ধর্মপ্রচারের জন্য গোয়া থেকে পাদ্রীদের আসা যাওয়া তখন লেগেই থাকত। ১৫৯৯ সালে এরকমই দুইজন অগাস্টিনিয়ান পাদ্রীর হুগলীতে আগমনের প্রাক্কালে পর্তুগিজরা হুগলীতে তৈরি করে একটি কনভেন্ট ও একটি গীর্জা। কনভেন্টটি উৎসর্গ করা হয় টলেনটিনোর সেন্ট নিকোলাসের (St. Nicholas of Tolentino) উদ্দেশ্যে, আর গীর্জাটি ‘আওয়ার লেডি অফ রোসারি’ (Our Lady of Rosary)-এর উদ্দেশ্যে। একাধিক সংস্কার এবং পুনর্নিমাণের পর এই গীর্জাটি আজও স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে ‘ব্যাসিলিকা অফ দি হোলি রোসারি’ বা লোকমুখে ‘ব্যান্ডেল চার্চ’ নামে। ১৫৯৯ সালে গীর্জাটি ঠিক কোথায় নির্মাণ করা হয়েছিল সে নিয়ে তর্কের অবকাশ আছে। যেহেতু সেই সময়ে পর্তুগিজদের শহরটি ছিল বর্তমান হুগলী জেল সংলগ্ন অঞ্চলে, গীর্জাটিও তাই তার আশেপাশেই কোথাও থাকা উচিৎ বলে মনে হয়। কিন্তু বহু ঐতিহাসিক ও ব্যান্ডেল গীর্জার বর্তমান প্রায়র ফাদার টি. এল. ফ্র্যান্সিসের মতে গীর্জাটি বরাবর বর্তমান চার্চের স্থানেই ছিল।
বাংলার নদীপথে পর্তুগিজদের জলদস্যুবৃত্তি, দাস ব্যাবসার উদ্দেশ্যে অপহরণ ও মানুষ পাচার, বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ ইত্যাদি নানা কারণে পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে বাংলার সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে একটি গণরোষ তৈরি হয়েছিল। ইতিমধ্যে যুবরাজ খুররম দিল্লীর সিংহাসন দখলের জন্য হুগলীর পর্তুগিজদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু পর্তুগিজরা তাঁকে সাহায্য করা থেকে বিরত থাকে। ১৬২৮ সালে যুবরাজ খুররম সম্রাট শাহজাহান নাম নিয়ে মুঘল সম্রাটের সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ১৬৩২ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর নির্দেশে মুঘল সৈন্য হুগলী আক্রমণ করে। প্রায় সাড়ে তিন মাসব্যাপী যুদ্ধের পর পর্তুগিজরা মুঘলদের কাছে পরাজিত হয় ও হুগলী থেকে বিতাড়িত হয়। বহু পর্তুগিজ বণিক জাহাজে করে পালাবার সময় হুগলী নদীতে ডুবে মারা যায় এবং খুব অল্প-সংখ্যক হুগলী ছেড়ে পালাতে সক্ষম হয়। ৪,৪০০ জন পর্তুগিজকে বন্দী করে আগ্রা নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর আগ্রাতেই সেই আশ্চর্য ঘটনাটি ঘটে। পর্তুগিজ বন্দীদের মধ্যে ছিলেন পাদ্রী জোয়াও দা ক্রুজ (Frei Joao da Cruz)। তাঁকে ফেলে দেওয়া হয় এক উন্মত্ত হাতীর সামনে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে হাতীটি তাঁর কোন ক্ষতি করার বদলে শান্ত হয়ে তাঁকে পিঠে তুলে বসায়। এই ঘটনায় আশ্চর্য হয়ে সম্রাট শাহজাহান বিপুল অর্থ, ক্ষমতা এবং ৭৭৭ বিঘা জমি দান করে পর্তুগিজদের পুনরায় হুগলীতে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৬৩৩ সালে পর্তুগিজরা ফের হুগলীতে ফিরে আসে, এবং ১৬৩২ সালের যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত হুগলী শহরের উত্তরে (বর্তমান ব্যান্ডেল) এক শহর স্থাপন করে। ১৬৩২ সালের যুদ্ধে পর্তুগিজ গীর্জাটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। ১৬৪০ থেকে ১৬৬০ সালের মধ্যে কোন এক সময়ে পর্তুগিজরা বর্তমান ব্যান্ডেল গীর্জাটির স্থানে চার্চটি পুনর্নিমাণ করে। নতুন করে বানানোর সময়, ১৬৩২ সালের দুঃস্মৃতি মুছে ফেলার জন্যই যেন গীর্জাটির স্থাপনকাল উল্লেখ করা হয় ১৫৯৯, যা কিনা আসলে পুরনো গীর্জাটিরই স্থাপনকাল।
এরপরেও একাধিকবার গীর্জাটি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ১৭৫৬ সালে কোলকাতায় ইংরেজদের পুরনো ফোর্ট ধ্বংস করে মুর্শিদাবাদ ফেরার পথে বাঙলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা ব্যান্ডেলের গীর্জা সংলগ্ন পর্তুগিজ নগরীতে লুঠতরাজ চালান। গীর্জাটি সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও গীর্জার যাবতীয় নথিপত্র আগুনে নষ্ট হয়ে যায়। সে কারণে ১৭৫৬ সালের আগেকার কোন নথি, যা তখনকার ইতিহাসের উপর আরো সুস্পষ্টভাবে আলোকপাত করতে পারত, তার কিছুই আজ আর অবশিষ্ট নেই। এর ঠিক পরের বছরেই অর্থাৎ ১৭৫৭ সালে ইংরেজরা সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলে ব্যান্ডেল চার্চ পরিণত হয় ইংরেজদের সামরিক শিবিরে। এর পর ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে গীর্জার দক্ষিণদিকের প্রবেশদ্বারের সামনে অবস্থিত মিনারটি ধ্বসে পড়ে হয়। ‘আওয়ার লেডি অফ হ্যাপি ভয়েজ’-এর মূর্তিতে ও গীর্জার দেওয়ালে নানা জায়গায় ফাটল ধরে। কিন্তু তৎকালীন ফাদার দা সিলভা (P.M. da Silva) শীঘ্রই এই সমস্ত ক্ষয়ক্ষতি মেরামত করান এবং মিনারটি নতুন করে নির্মাণ করান। ১৯১০ সালে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের পর গীর্জার সামনে একটি ঝোলানো বারান্দা তৈরি করা হয় এবং ‘আওয়ার লেডি অফ হ্যাপি ভয়েজ’-এর মূর্তিটিকে দোতলার বারান্দায় স্থানান্তরিত করা হয়।
চার শতকেরও বেশি পুরনো এই গীর্জা বহু ইতিহাসের সাক্ষী থেকেছে। বহু জাতির পায়ের ধুলো পড়েছে এই গীর্জার প্রার্থনাগৃহে। তাই গীর্জাটি নিয়ে কিংবদন্তি গল্পকথারও শেষ নেই। তার মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য দুটি গল্প জড়িয়ে আছে ‘আওয়ার লেডি অফ হ্যাপি ভয়েজ’ নামক মা মেরীর মূর্তিটি নিয়ে এবং গীর্জায় রাখা একটি জাহাজের মাস্তুল নিয়ে।
বলা হয় ‘আওয়ার লেডি অফ হ্যাপি ভয়েজ’ নামক মেরী মাতার মূর্তিটি আসলে ছিল পর্তুগিজদের পুরনো শহর হুগলীর এক মিলিটারি চ্যাপেলে। ১৬৩২ সালে মুঘলদের আক্রমণের সময় মূর্তিটিকে রক্ষা করার জন্য তিয়াগো (Tiago) নামে এক পর্তুগিজ বণিক মূর্তিটি নিয়ে হুগলী নদী পার করে অপর পারে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে। কিন্তু মুঘলদের আক্রমণে তিয়াগো মাঝ নদীতেই মারা যায় এবং মূর্তিটিও নদীতে ডুবে যায়। এর বেশ কিছু বছর পর (১৬৪০-১৬৬০) শাহজাহানের নতুন ফর্মানের বলে পর্তুগিজরা ব্যান্ডেলে গীর্জাটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। নতুন গীর্জা পত্তনের কিছুদিন পর তৎকালীন পাদ্রী জোয়াও দা ক্রুজ (Frei Joao da Cruz) নাকি এক রাতে নদী থেকে দৈববাণীর মত ডাক শুনতে পান। পরদিন সকালে তিনি নদীর ধারে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে দেখেন যে মেরী মাতার মূর্তিটি নদী থেকে জেগে উঠেছে। মূর্তিটিকে সেখান থেকে তুলে এনে গীর্জার মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা প্রায় আড়াইশো বছর পর ১৯১০ সালে গীর্জার ছাদে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
পর্তুগিজরা ব্যান্ডেলে ফিরে আসার পর নতুন করে গীর্জাটি বানানো হবার কিছুদিন পরেই একটি পর্তুগিজ জাহাজ ভয়ঙ্কর এক ঝড়ের কবলে পরে এসে উপস্থিত হয় গীর্জার সামনে হুগলী নদীতে। জাহাজের কাপ্তান ঈশ্বরের কাছে মানত করেছিলেন যে ঝড়ের কবল থেকে প্রাণে বাঁচলে জাহাজের প্রধান মাস্তুলটি তিনি গীর্জায় দান করবেন। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হোক বা পর্তুগিজ নৌপ্রযুক্তির গুণেই হোক, সে যাত্রা জাহাজটি ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পায়, এবং কাপ্তান তার মানত অনুসারে জাহাজের একটি মাস্তুল ব্যান্ডেল চার্চে দান করেন। মাস্তুলটি দীর্ঘদিন গীর্জার সামনে কবরখানার ঠিক পাশেই শোভিত হত। ২০০৯ সালে কুখ্যাত আয়লা ঝড়ে মাস্তুলটি ভেঙে পড়ে।
তবে মাস্তুল ভেঙে পড়লেও মাতা মেরীর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা রয়েছে অটুট। তাই ডিসেম্বরের শীতের আমেজে হাজার হাজার মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে প্রতি বছর চলে আসেন ব্যান্ডেল চার্চের সবুজ চত্বরে কিছুটা সময় কাটিয়ে যাওয়ার জন্য। মোমের শিখা জ্বেলে মনের অপূর্ণ বাসনাকে মেরী মায়ের উদ্দেশ্যে জানিয়ে দিয়ে যান কেউ কেউ। ডিসেম্বর জানুয়ারি এই দুটি মাস ব্যান্ডেল চার্চে তিল ধারণের জায়গা থাকেনা। এ প্রসঙ্গে ব্যান্ডেল ব্যাসিলিকার বর্তমান প্রায়র ফাদার টি. এল. ফ্র্যান্সিস বলেন, “আমাদের এখানে সারা বছর ধরে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত প্রকার মানুষ আসেন, আর বিশেষ করে ক্রিসমাসের সময় চার্চ প্রাঙ্গনে মানুষের ঢল নামে”। তবে কেবলই বেড়ানো বা পিকনিক করতে আসাই উদ্দেশ্য নয়, আরো একটি কারণে দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ ব্যান্ডেল চার্চে আসেন। “ব্যান্ডেলের মেরী মাতার এখানে আজও মিরাকল ঘটে। বহু অসুস্থ মানুষ এখানে এসে মেরী মাতার কাছে প্রার্থনার মাধ্যমে সম্পূর্ণ সেরে উঠেছেন, যাদের মধ্যে অনেক হিন্দু ও মুসলমানও রয়েছেন…”, ফাদার ফ্রান্সিস যোগ করেন।
কিভাবে যাবেন :
ট্রেনঃ- হাওড়া থেকে ব্যান্ডেল লোকাল বা মেন লাইন বর্ধমান লোকালে চেপে ব্যান্ডেল স্টেশনে নামুন। শেয়ালদা’র দিক দিয়ে এলে নৈহাটি থেকে ট্রেন বদল করে নৈহাটি-ব্যান্ডেল লোকাল ধরে চলে আসুন ব্যান্ডেল স্টেশন। ব্যান্ডেল স্টেশন থেকে অটো বা টোটোতে দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যান ব্যান্ডেল চার্চ।
সড়ক পথঃ- সড়ক পথে কোলকাতার দিক থেকে এলে জি.টি. রোড ধরে প্রথমে ব্যান্ডেল মোড় পৌঁছান। সেখান থেকে ডান দিক নিয়ে সোজা বালির মোড়, বালির মোড় থেকে বাঁ দিক নিয়ে ২ মিনিটে ব্যান্ডেল চার্চ পৌঁছে যান।
বি.দ্র.- ব্যান্ডেল চার্চ দেখা হয়ে গেলে চার্চের পিছন দিকে গঙ্গার ধার থেকে নৌকা ভাড়া করে ১৫ মিনিটে হুগলী ইমামবারা ঘুরে আসতে পারেন।
গ্রন্থঋণ
History of the Portuguese in Bengal – Joachim Joseph A. Campos
Hoogly Past and Present – Shumbhoo Chunder Dey
লেখা ও ছবি
প্রোজ্জ্বল দাস