সোনার বেণে থেকে বৈষ্ণব সাধক – সপ্তগ্রামের উদ্ধারণ দত্ত ঠাকুর (From Gold Merchant to Vaishnava Sadhaka – Uddharan Dutta of Saptagram)

সময়টা পনেরশ শতকের শেষ দিক। গৌড়বঙ্গে তখন সুলতানি শাসনের স্থিমিত নদীতে এসে লাগছে ভক্তি আন্দোলনের ঢেউ। বঙ্গদেশকে প্রেমরসে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়ে পথে নেমেছেন নবদ্বীপের শ্রী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু। বাংলার মধ্য ও নিম্নবর্গের মানুষের সামাজিক সচলতা এবং চৈতন্যদেবের হাত ধরে সামাজিক আন্দোলনে তাদের স্তর নিরপেক্ষ অংশগ্রহণ বাংলার শাসক সুলতানদের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে ওঠে। চৈতন্যদেবের লক্ষ্য ছিল ব্রাহ্মণ্য হিন্দু সমাজের চৌহদ্দির বাইরে বাংলার যে বিশাল বৌদ্ধ ও লোকায়ত ধর্মের মানুষরা রয়েছেন তাঁদেরকে একত্র করে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসা। এই পরিস্থিতিতে হিন্দু সমাজে জল-অচল হয়ে থাকা সুবর্ণবণিক সমাজকে ভক্তি আন্দোলনে সামিল করতে পারাটা একদিকে যেমন চৈতন্যপন্থীদের কাছে ছিল সামাজিক আন্দোলনে এক বিশাল জয়ের সমান, একই ভাবে সুবর্ণ বণিকদের কাছেও তা ছিল এক সামাজিক শাপমুক্তি! আর যাঁর হাত ধরে সুবর্ণবণিকদের এই শাপমুক্তি ঘটেছিল তিনি হলেন সপ্তগ্রামের বণিক কুলপতি শ্রী উদ্ধারণ দত্ত।

dsc08375
উদ্ধারণ দত্তর অষ্টধাতুর মূর্তি

সুবর্ণবণিকদের জাতিচ্যুত ও অস্পৃশ্য হওয়ার গল্প এই ব্লগে সুবর্ণবণিকদের মল্লিকবাড়ির দুর্গাপুজোর প্রসঙ্গে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। গৌড়বঙ্গের রাজা বল্লাল সেনের কোপে পড়ে সুবর্ণবণিকরা জাতিচ্যুত হয়, যার উল্লেখ রয়েছে ‘বল্লালচরিত’ গ্রন্থে —

“যদি দাম্ভিকান সুবর্ণান বণিজঃ শূদ্রত্বে না পাতরিষ্যামি
বল্লভচন্দ্র সৌদাগিরস্য দুরাত্মনো দন্ডাং না বিধাস্যামি
তদা গো ব্রাহ্মণ ঘাতেন যানি পাতকানি ভবিতব্যানি
তা নি মে ভবিষ্যন্তীতি।”

অর্থাৎ, “আমি যদি দাম্ভিক সুবর্ণদিগকে শূদ্রত্বে পতিত না করি, বল্লভচন্দ্রের মত দুরাত্মা সদাগরদের দন্ড না দিই, তাহলে গো ব্রাহ্মণ হ্ত্যার যে পাপ আমারও সে পাপ হবে।”

হুগলীর সপ্তগ্রাম তখন বাংলার অন্তর্দেশীয় বাণিজ্যের একটি অন্যতম প্রধান ঘাঁটি। ত্রিবেণীর যে স্থানে সরস্বতী নদীর গতিপথটি গঙ্গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পশ্চিম দিকে যাত্রা করেছে তারই একটু দূরে ছিল সপ্তগ্রামের বন্দর। আজকের সরস্বতী খাল সেকালে ছিল স্রোতস্বিনী নদী। ত্রিবেণীতে শুরু হয়ে হুগলীর ভিতরের নানা পথ ঘুরে বেতোরের কাছে (আজকের হাওড়ার বোটানিকাল গার্ডেনের নীচ দিয়ে) তা আবার গঙ্গায় মিশে যেত। সপ্তগ্রামের বন্দরে সে কালে আরব, ইরান ও চীন দেশ থেকে আগত বণিকদের ছিল নিত্য আনাগোনা। আর ছিল গুজরাটি ও বাঙালি বণিকদের বাণিজ্যতরীর ভিড়, যাদের মধ্যে বাঙালি সুবর্ণবণিকরাই ছিল প্রধান। এই বন্দর থেকেই সারা বাংলায় উৎপাদিত খাদ্যশস্য ও মসলিনে নৌকা বোঝাই করে বণিকরা পাড়ি জমাত বঙ্গোপসাগর ধরে এশিয়ার নানা প্রান্তে।

dsc03204
সেদিনের সরস্বতী নদী আজকের সরস্বতী খাল

১৪৮১ খ্রিস্টাব্দে এই সপ্তগ্রামেরই এক সুবর্ণবণিক পরিবারে শ্রীকর দত্ত ও ভদ্রাবতী দেবীর ঘরে জন্ম হয় দিবাকর দত্ত নামে এক শিশুপুত্রের। দিবাকর দত্তের বেড়ে ওঠা সপ্তগ্রামেই। মাত্র ২৬ বছর বয়সে তাঁর পত্নীবিয়োগ হয় এবং তিনি গৃহত্যাগ করে শ্রী নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর শরণে আসেন ও বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন। নিত্যানন্দ তাঁর নতুন নামকরণ করেন ‘উদ্ধারন’ অর্থাৎ যার হাত ধরে সুবর্ণবণিকদের জগত উদ্ধার হবে। অল্প কালের মধ্যেই তিনি শ্রী নিত্যানন্দের বিশেষ স্নেহভাজন নিত্যপার্ষদ হয়ে ওঠেন। শোনা যায় নিত্যানন্দ উদ্ধারন দত্তের রান্না করা অন্ন ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করতেন না।

“স্বর্ণ বণিক উদ্ধারণ দত্ত ভক্তোত্তম।
যাহার পক্বান্ন নিতাই করেন ভক্ষণ।।”

চৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশে নিত্যানন্দ যখন বিবাহ করায় সম্মতি দেন তখন তাঁর জন্য পাত্রী খোঁজার ভার উদ্ধারণ দত্তের উপরেই বর্তায় এবং তিনি নিত্যানন্দের বিবাহে দশ হাজার টাকা ব্যয় করেন বলেও জানা যায়। নিত্যানন্দ সপ্তগ্রামে উদ্ধারণ দত্তের বাড়িতে নিয়মিত আসতেন এবং থাকতেন। উদ্ধারণ দত্ত সপ্তগ্রামে তাঁর নিজের বসতবাটিতে একটি রাধাবল্লভ মন্দির স্থাপন করেন যেখানে প্রভু নিত্যানন্দ নিজে হাতে একটি মাধবীলতা বৃক্ষ রোপন করেন। সেই গাছ আজও আছে।

img_8257
শ্রী নিত্যানন্দ প্রভুর নিজে হাতে রোপণ করা সেই মাধবীলতা গাছ
dsc03181 copy
উদ্ধারণ দত্তের বাড়ির পুকুরঘাট, যেখানে নিত্যানন্দ এসে স্নান করতেন

গৌড়ীয় বৈষ্ণব জগতে উদ্ধারণ দত্ত এক প্রাতঃস্মরণীয় উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। মহাকবি কর্ণপুরের শ্রীগৌরগণোদ্দেশ দীপিকা ‘য় উল্লেখ আছে – “সুবাহুয়োব্রজে গোপা দত্ত উদ্ধারণাখ্যক”। শ্রী রাজবল্লভ গোস্বামীর “শ্রীশ্রীমুরলী বিলাস”, অভিরাম দাসের “পাট পর্যটন” ইত্যাদি বৈষ্ণব শাস্ত্রগ্রন্থ মতে দ্বাপরের শ্রীধাম বৃন্দাবনের দ্বাদশ গোপালের অন্যতম ‘সুবাহু’ই কলিতে সপ্তগ্রামের উদ্ধারণ দত্ত রূপে জন্মগ্রহণ করেন।

সে কালে দুর্ভিক্ষ ছিল বাংলার নিত্য সঙ্গী। সেরকমই এক দুর্ভিক্ষের সময় উদ্ধারণ দত্ত আদিসপ্তগ্রামে ত্রিশ বিঘা স্থান জুড়ে একটি অন্নসত্র খোলেন যা দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের দুই বেলা আহারের একমাত্র ভরসাস্থল ছিল। পরবর্তীকালে এই সমস্ত কৃতজ্ঞ মানুষদের তিনি বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত করেন। এই ত্রিশ বিঘা অন্নসত্র থেকেই গ্রামটির নাম হয় ত্রিশ বিঘা। শুধু দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষই নয়, উদ্ধারন দত্তের প্রভাবে সপ্তগ্রামের সমস্ত সুবর্ণবণিকরা দলে দলে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। শ্রী শ্রী নিত্যানন্দ মহাপ্রভু এবং উদ্ধারণ দত্তের সংস্পর্শে এসে হিন্দু সমাজে ব্রাত্য সুবর্ণবণিকরা প্রেম-ভক্তির নতুন দিশা খুঁজে পায়।বৃন্দাবন দাসের ‘শ্রীচৈতন্য ভাগবৎ’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধারণ দত্ত সম্পর্কে আছে —

“উদ্ধারণ দত্ত ভাগ্যবন্তের মন্দিরে।
রহিলেন মহাপ্রভু ত্রিবেণীর তীরে।।
কায়মনোবাক্যে নিত্যানন্দের চরণ।
ভজিলেন অকৈতবে দত্ত উদ্ধারণ।।
যতেক বণিককুল উদ্ধারণ হইতে।
পবিত্র হইলো, দ্বিধা নাহিক ইহাতে।।
বণিক ত্বরিতে নিত্যানন্দ অবতার।
বণিকের দিলা প্রেমভক্তি অধিকার ।। ”

হুগলীর আদিসপ্তগ্রাম স্টেশনের কাছেই উদ্ধারণ দত্তের আদি বসতবাড়ির মন্দিরে আজও শোভা পাচ্ছে “দক্ষিণে নিত্যানন্দ বামে গদাধর – মধ্যে ষড়ভুজ মূর্তি শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দর”, এবং নিম্নে শ্রীমদ উদ্ধারণ দত্ত ঠাকুরের অষ্টধাতুর মূর্তি।

img_8281
উদ্ধারণ দত্তর শ্রীপাটে মন্দিরের বর্তমান প্রধান পুরোহিত শ্রী সুব্রত চক্রবর্তী সহ সিংহাসনে আসীন বিগ্রহ
dsc08371
“দক্ষিণে নিত্যানন্দ, বামে গদাধর – মধ্যে ষড়ভুজ মূর্তি শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দর”, উদ্ধারণ দত্তর শ্রীপাট, আদি সপ্তগ্রাম

১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে এখানে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় যা আজও বর্তমান ।মন্দিরটি কালের নিয়মে জীর্ণ হয়ে যায়। এদিকে সরস্বতী নদীতে পলি পড়ে যাওয়ার ফলে সপ্তগ্রামের সুবর্ণবণিকরা একে একে পাড়ি জমাতে থাকে হুগলি-চুঁচুড়া-চন্দননগর ও কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে। পরে হুগলী জেলার সাব-জাজ শ্রী বলরাম মল্লিকের তৎপরতায় মন্দিরটি সংস্কার করা হয়। কোলকাতা, হুগলী, চুঁচুড়া ইত্যাদি নানা স্থানে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য সুবর্ণবণিক পরিবারগুলি এগিয়ে আসে এবং ১৮৯৯ সালে একটি সভা ও পরে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সমিতির প্রধান কার্যভারের মধ্যে ছিল জীর্ণ মন্দিরটির সংস্কার, উদ্ধারণ দতের তিরোভাব দিবস উদযাপন ও শ্রীপাটের সংরক্ষণ। পরবর্তী কালে এই বার্ষিক সভা স্বজাতি সম্মেলনীতে পর্যবসিত হয়। শোনা যায় সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের প্রতিটি সভাতে দেড় হাজারেরও বেশী জনসমাগম হত, এবং কোলকাতার সুবর্ণবণিক সভার অনুপ্রেরণাও এই সম্মেলন থেকেই আসে বলেও অনেকে মনে করেন।

img_8258

img_8273
নাটমন্দির
img_8265
উদ্ধারণ দত্তের রাধাবল্লভ মন্দির

১৫৪১ খ্রিস্টাব্দে বৃন্দাবনে উদ্ধারণ দত্তের মৃত্যু হয়। বৃন্দাবনে তাঁর মূল সমাধি-মন্দির থেকে কিছু ফুল নিয়ে এসে পরে সপ্তগ্রামের বর্তমান শ্রীপাটে তাঁর প্রিয় মাধবীলতা গাছটির পাশেই একটি পুষ্পসমাধি মন্দির নির্মাণ করা হয়। প্রত্যেক বছর পৌষমাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে উদ্ধারণ দত্তের তিরোধান তিথিতে এখানে মহোৎসব পালন করা হয়।

dsc08367
মন্দিরের দক্ষিণে উদ্ধারণ দত্তর সমাধি মন্দির

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বর্ধমানের কাটোয়া থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে গঙ্গার ধারে রয়েছে বিখ্যাত উদ্ধারণপুরের ঘাট। প্রভু নিত্যানন্দের আদেশে উদ্ধারণ দত্ত এখানে মহাশ্মশানের পাশে নিজের সাধনার জন্য আশ্রম তৈরি করেন। উদ্ধারণ দত্তের নামানুসারেই পরে এই স্থানের নাম হয় উদ্ধারণপুর। হুগলী জেলারই আরেক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক সাহিত্যিক কালিকানন্দ অবধূত রচিত বিখ্যাত “উদ্ধারণপুরের ঘাট’ উপন্যাসটি এই ঘাট এবং শ্মশানকে কেন্দ্র করেই লিখিত। আজও প্রতিবছর মকর সংক্রান্তির সময় এখানে বিশাল মেলা বসে।

uddharanpur
কাটোয়ার উদ্ধারণপুরের শ্মশানের পাশেই অবস্থিত উদ্ধারণ দত্ত ঠাকুরের পুষ্প-সমাধি মন্দির ও আশ্রম

 

 

সহায়ক গ্রন্থ –
হুগলী জিলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ – সুধীর কুমার মিত্র
উদ্ধারণ দত্ত কথামৃত – বৈদ্যনাথ ভৌমিক 
 
লেখা – সুচিন্ত্য মল্লিক
ক্ষেত্র গবেষণা – শঙ্খশুভ্র গঙ্গোপাধ্যায়
ছবি – প্রোজ্জ্বল দাস, অরুণাভ পাত্র 

 

One comment

Leave a reply to Anjan Adhya Cancel reply